প্রকাশিত : রবিবার , ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , দুপুর ১২:৫২।। প্রিন্ট এর তারিখঃ শনিবার , ১৬ আগস্ট ২০২৫ , বিকাল ০৪:২৮
রিপোর্টার : অনলাইন ডেস্ক

দ্বৈত শাসন বিলোপ না হলে বিচার বিভাগ প্রকৃত স্বাধীন হবে না’


রিপোর্টার : the investor

বিচার বিভাগে দ্বৈতশাসন ব্যবস্থার অবসান চেয়েছেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। একই সঙ্গে বিচার বিভাগ যেন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে সেজন্য জরুরি ভিত্তিতে কিছু সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।

শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে দেওয়া এক অভিভাষণে এই প্রস্তাব দিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের স্বার্থে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ দ্বৈত শাসন বিলোপ বাস্তবায়ন একান্ত আবশ্যক।

তিনি বলেন, সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-অধস্তন আদালতের বিচারকগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন। কিন্তু বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা ততদিন পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না; যতদিন না বিচার বিভাগে দীর্ঘ দিন ধরে বিরাজমান দ্বৈতশাসন ব্যবস্থার অবসান না হয়। অর্থাৎ, সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এক্তিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে জরুরি ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটি হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথম ধাপ।

সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এম, আসাদুজ্জামান বক্তব্য রাখেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এবং নিম্ন আদালতের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ২ হাজার বিচারক এতে অংশ নেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে অধস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর হাইকোর্ট বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা থাকার কথা বলা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদের বুনিয়াদে সংবিধানের কোনো সংশোধন না করেই শুধু রুলস অব বিজনেস এবং বিচারকদের নিয়োগ, কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, বরখাস্তকরণ, শৃঙ্খলা বিধান ইত্যাদি সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত যেসব বিধিমালা প্রচলিত রয়েছে সেগুলোতে প্রদত্ত 'উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ'-এর সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনে সেখানে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সচিবকে অন্তর্ভুক্ত করলেই সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় তথা বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পথে আইনগত বাধা দূর হবে।

এছাড়া জেলা আদালতসমূহের বাজেট বরাদ্দের বিষয়টিও তখন বিচার বিভাগীয় সচিবালয় হতেই নিশ্চিত হবে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের মতো বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তাব প্রস্তুত করে আমরা শিগগিরই আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করব। উক্ত প্রস্তাব বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আমি প্রধান উপদেষ্টা এবং আইন উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমি বিশ্বাস করি, বর্তমান সময়ই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের শ্রেষ্ঠ সময়।

তিনি বলেন, বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পর বিচার বিভাগে গুণগত পরিবর্তনে অন্যতম কাজ হবে বিচারকগণের যোগ্যতার ভিত্তিতে পদায়ন নিশ্চিত করা। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের উর্ধ্বে উঠে কর্মরত বিচারকদের মধ্য থেকে সৎ, দক্ষ, স্বাধীন মনোভাব ও নেতৃত্বদানের গুণাবলিসম্পন্ন উপযুক্ত বিচারকদের নিয়ে প্যানেল বা ফিট লিস্ট তৈরি করা। ওই ফিট লিস্ট থেকে প্রতিষ্ঠানপ্রধান, যেমন-জেলা জজ, দায়রা জজ, সিজেএম, সিএমএম পদে নিয়োগ নিশ্চিত করা হবে। যেন বিচার বিভাগ পূর্বের শাসনামলের মতো ভীতু ও আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে না পারে। বৈষম্য নিরসনে বর্তমানে বিচারকগণের পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে একটি যথোপযুক্ত নীতিমালা দ্রুত প্রণয়ন করা হবে।

তিনি বলেন, স্বাধীন বিচার বিভাগের অন্যতম শর্ত হচ্ছে বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। এজন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে জেলা আদালতসমূহের জন্য সরকারকে স্বতন্ত্র বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। বিচার বিভাগের উন্নয়ন ও পরিচালন বাবদ যে বাজেট চাওয়া হবে সরকারকে তা দিতে হবে।

প্রধান বিচারপতি বলেন, শুধু বিচার বিভাগীয় পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করলেই হবে না, সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা হিসেবে সংবিধানের ৯৫ (২) অনুচ্ছেদে যে বিধান রয়েছে কেবল সেটুকু নিশ্চিত করে বিচারক নিয়োগের ফলে সুপ্রিম কোর্টে এক অভূতপূর্ব অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হিসেবে পালন করেছে। এটি ন্যায় বিচারের ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। তাই উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে অন্যান্য দেশসমূহে অনুসৃত আধুনিক পদ্ধতিসমূহ বিবেচনায় নিয়ে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে একটি কলেজিয়াম ব্যবস্থা চালু করতে সচেষ্ট হব।

তিনি বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করতে সমগ্র বিচার বিভাগের সাংগঠনিক কাঠামো বা অরগানোগ্রাম সংস্কার করে জনসংখ্যা ও মামলার সংখ্যা অনুপাতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে এক জন বিচারক একই সঙ্গে একাধিক কোর্ট এবং ট্রাইব্যুনালের দায়িত্বে থাকেন, তা বিলোপ করে এক জন বিচারককে একটি কোর্টের দায়িত্ব দিতে হবে। আনতে হবে আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধন। এছাড়া দেওয়ানি ও ফৌজদারি এক্তিয়ার অনুসারে পৃথক আদালত স্থাপন করা দরকার। এছাড়া মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা বিচারপ্রার্থীদের দীর্ঘশ্বাসের কারণ। বিচার ব্যবস্থাকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যেন-বিচারপ্রার্থীদের সময় ও খরচ উল্লেখযোগ্য হারে কমে। আদালত প্রাঙ্গণে যেন তাদের বারবার না আসতে হয়। এই বিষয়টি বিচারকের একার ওপর নয়, এক্ষেত্রে বারের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।

এছাড়া জুডিশিয়াল সার্ভিস পে কমিশনের সুপারিশ পুরোপুরি বাস্তবায়ন, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা- কর্মচারী, সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ সৃজনে সুপ্রিম কোর্টের স্বাধীনতা, অতিরিক্ত জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারকদের গাড়ি সুবিধা, এজলাস ও চেম্বার সংকট নিরসন, দ্রুত স্টোনোগ্রাফার/স্টোনোটাইপিস্ট নিয়োগ, ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়ন, বিচারকদের প্রশিক্ষণ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ওপর জোড় দেন প্রধান বিচারপতি।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ফৌজদারি মামলার তদন্ত কাজ যেন দীর্ঘ দিন ঝুলে না থাকে, পুলিশকে সে ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে। চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত রিপোর্ট দিতে ইতিমধ্যে ১১১ বার সময় নেওয়া হয়েছে। যা কাম্য নয়। তদন্তেই যদি একাধিক বছর লেগে যায়, তখন বিচারকাজ পরিচালনা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। কেননা সময়ের আবর্তে মামলার অনেক সাক্ষী ও সাক্ষ্য হারিয়ে যায়।

তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোতে বিচার বিভাগের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। শঠতা, বঞ্চনা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে বিচার বিভাগকে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে। এতে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। তাই নতুন বাংলাদেশে আমরা এমন একটি বিচার বিভাগ গড়তে চাই যেটি বিচার এবং সততা ও অধিকারবোধের নিশ্চয়তার একটি নিরাপদ দুর্গে পরিণত হবে কেননা শাসকের আইন নয়, বরং আইনের শাসন নিশ্চিত করাই বিচার বিভাগের মূল দায়িত্ব।