জ্ঞানী ও গুণীরা বলেন, হতাশা বা ব্যর্থতার শেষ আছে কিন্তু সাফল্যের শেষ নেই। বিজ্ঞানী এডিসন সাফল্য সম্পর্কে বলেন, মেধা ১ শতাংশ এবং পরিশ্রম ৯৯ শতাংশ। এই সাফল্য বা সফলতা শুধু স্বাভারিক মহামানব বা মনীষীরাই নয়, অস্বাভাবিক শারীরিক গঠন বা প্রতিবন্ধীরাও এর থেকে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। পৃথিবীর প্রথম মহাকাব্য লিখেছিলেন জন্মান্ধ মহাকবি হোমার। প্রতিবন্ধী হয়েও নিজ নিজ প্রতিভার বিকাশ ঘটান বর্তমান শতাব্দীর শারীরিক প্রতিবন্ধী শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং, জন্মান্ধ ফরাসি সাহিত্যিক রোদাকি, খঞ্জ লর্ড বায়রণ, আধুনিক আরবি কবিতার জনক অন্ধ বাশশার বিন বোরদ, আধুনিক আরবি সাহিত্যের জনক অন্ধ ড. তাহা হোসাইন, আরবি ভাষার মহান কবি ও যুক্তিবাদী দার্শনিক অব্দ কবি আবুল আলা আল মা আরবি, মহান সুরস্রষ্টা বধির বিটোফেন, বিখ্যাত আমেরিকান অন্ধ গায়ক রে চার্লস প্রমুখ।
৪৪ বছর বয়সে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যান জন মিন্টন, এর ১৬ বছর পর লিখেছিলেন 'প্যারাডাইজ লস্ট'। ফরাসি নাগরিক লুইস ব্রেইল (১৮০৯-১৮৫২) অত্যন্ত মেধাবী, প্রতিভাবান ও অধ্যবসায়ী ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব। তিন বছর বয়সে পিতার কারখানায় খেলাধুলার সময় সুইজাতীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে চামড়ায় গর্ত করার সময় সংঘটিত এক দুর্ঘটনায় তার চোখ দুইটি চিরতরে নষ্ট হয়ে যায় এবং তিনি অন্ধ হয়ে যান। অন্ধ হয়ে গেলেও বন্ধ হয়ে যায়নি তার মেধার স্ফুরণ। চক্ষুহীন জীবনকে চক্ষুময় জীবনের মতো উপভোগের উপায় খুঁজে বের করার প্রাণান্তকর চেষ্টায় নিবেদিত হয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি অন্ধদের লেখা ও পড়ার জন্য কাগজের ওপর মাত্র ছয়টি ডট দিয়ে জাদুকরি একটি অতি সহজ ভাষা ও পদ্ধতি (ব্রেইল ভাষা) আবিষ্কার করে সবাইকে হতবাক করে দেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত অব্দ লোকেরা ছয়টি ডটের অনবদ্য জাদু দিয়ে নিজেকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলে তাদের জীবনযাত্রার মান সম্পূর্ণ বদলে দেন। তার আবিষ্কৃত ভাষার জন্য পৃথিবীবাসী শ্রদ্ধার সঙ্গে তার জন্মদিন অর্থাৎ ৪ জানুয়ারিকে বিশ্ব ব্রেইল দিবস হিসেবে পালন করে। তার প্রতি আজ বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে আজকের নতুন প্রজন্মের উৎসাহ-উদ্দীপনা বৃদ্ধির জন্য একজন প্রতিবন্ধী কিন্তু আলোকিত ও কিংবদন্তির জীবনের সোনালি উজ্জ্বল চুম্বক অংশ না লিখে পারছি না।
উনিশ শতকের অসাধারণ এক নারী হেলেন কেলার। প্রখ্যাত সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন বলেছেন, উনবিংশ শতাব্দীর দুইটি সর্বশ্রেষ্ঠ চরিত্র নেপোলিয়ন এবং হেলেন কেলার। প্রথম জন গায়ের জোরে পৃথিবী জয় করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলেন, দ্বিতীয় জন মনের জোরে পৃথিবী জয় করতে চেয়েছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন। উত্তর আমেরিকার আলবামা রাজ্যে টাসকাম্বিয়া নামে ছোট একটি শহরে আর্থার কেলার ও ক্যাথরিন কেলার দম্পতির ঘরে তিনি ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১৯ মাস বয়সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ধীরে ধীরে কথা বলা, শোনা ও দেখার শক্তিও চিরতরে হারিয়ে যায়। এরপর আট বছর বয়সে হাতে আঙুলে দিয়ে দাগ কেটে লেখা, ব্রেইল পদ্ধতিতে শব্দ ও বাক্য উচ্চারণ অর্থাৎ লেখাপড়া পুনরায় শুরু করলেন। ১৪ বছর বয়সে আমেরিকার নিউ ইয়র্কের রাইট হুমার্সন স্কুলে ভর্তি হন। । ১৯০৪ সালে তিনি র্যাডক্লিফ কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন, যার নাম না লিখলে হেলেনের জীবন অসম্পূর্ণ থাকবে, তিনি হলেন তার শিক্ষিকা অ্যান স্যালিভান। তাদের দুই জনের জীবন একসূত্রে গাঁথা। হেলেন নিজেই লিখেছেন 'তিনি যে বিশ্বের মানুষের সামনে দাঁড়াতে পেরেছেন, এর জন্য পুরো কৃতিত্ব তার পারকিন্স ইনস্টিটিউশনের মহতী শিক্ষিকার জন্য। ছাত্রীর হাতের ওপরে নির্দিষ্ট আঙুল সঞ্চালন করে তাকে শিক্ষা দেন এক অদ্ভুত পদ্ধতিতে। হেলেন প্রশ্ন জেনে টাইপ মেশিনে টাইপ করে বা হাতের আঙুলের ইশারায় উত্তর দিতেন। তিনি ইংরেজি, ল্যাটিন, ফরাসি, জার্মান ও গ্রিক ভাষা জানতেন।
হেলেন তার জীবনে বই পড়েছেন অনেক বেশি। তিনি নিজে চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, সংগীত উপভোগ করতেন বাদ্যযন্ত্রের ওপর হাত রেখে। হাতের ছোঁয়া দিয়ে শ্রবণের কাজ করতেন। মানুষের সঙ্গে করমর্দন করলে বলে দিতে পারতেন, আগের পরিচিত কি না। সাঁতার কাটা, নৌকা চালানো, দাবা খেলা, তাস খেলার পাশাপাশি ঘরে বসে নকশিকাঁথা সেলাই করতে পারতেন। কম্পনের অনুভূতি থেকে বলে দিতে পারতেন ছুতোর মিস্ত্রি করাত দিয়ে কাটছে, না রাঁদা চালাচ্ছেন, নাকি হাতুড়ি পেটাচ্ছেন। ফুলের পাঁপড়ি স্পর্শ করে ফুলের রং বলে দিতে পারতেন। তিনি নারী ও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের অধিকারে সর্বদা সচেতন ছিলেন। তিনি রাজনীতি করেছেন এবং বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরপর্বে যোগদান করতেন। তিনি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলতেন, 'আমি অন্ধ। তোমরা যারা দেখতে পাও, তাদেরকে আমি একটা কথা বলে যেতে চাই-চোখ দুটিকে তোমরা এমনভাবে ব্যবহার করো, যেন আগামীকালই তুমি অন্ধ হয়ে যাবে, আর দেখবে না। তোমার অন্য সব ইন্দ্রিয়ের বেলায়ও এমন করে ভাবতে শেখো। সুরের আওয়াজ, পাখির গান, বাদ্যকারের বাজনা এমনভাবে শুনবে, যেন কালই তুমি বধির হয়ে যাবে। প্রতিটি জিনিস এমন ভাবে ছুঁয়ে দেখবে, যেন তোমার স্পর্শশক্তি বিলুপ্ত হবে আগামীকালই। এমনভাবে নেবে ফুলের ঘ্রাণ আর খাদ্যের স্বাদ, যেন আগামীকাল আর তোমার গন্ধ কিংবা স্বাদের অনুভূতি অবশিষ্ট থাকবে না। সব ইন্দ্রিয়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার করো, প্রকৃতির সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করো।'
পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশ তাকে সম্মানসূচক ডিগ্রি, নাইট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৫৯ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক বিশেষ সম্মানে সম্মানিত হন। তিনি মনে করতেন, সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা বুদ্ধির জড়তা, আর উপভোগ হলো বাধা জয় করার আনন্দ। এই মহীয়সী অন্ধ-বধির ও মুক প্রতিবন্ধী নারী ১৯৬৮ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি কিংবদন্তি হয়ে বেঁচে ছিলেন এবং আজীবন বেঁচে থাকবেন কোটি মানুষের হৃদয়ে।