রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলেও বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হতে দেরি হচ্ছে। সরকার পরিচালিত পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ ২ জুন থেকে সঞ্চালন লাইন চালু করলেও পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হওয়ার তারিখ কয়েক মাস পিছিয়ে যেতে পারে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, সময়মতো উৎপাদন শুরু না হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক পরিবেশের অস্থিরতা এবং ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতি না থাকার কারণ রয়েছে। গত ছয় মাস ধরে রূপপুরে ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের আগমন বন্ধ রয়েছে। কর্মীদের ছাঁটাই ও অন্যান্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ফলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে। রাশিয়ার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রোসাটমও গুরুত্বপূর্ণ পদে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ এবং কর্মীদের ছাঁটাই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
রূপপুর প্রকল্পের মোট বিনিয়োগ প্রায় এক লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় একক প্রকল্প। এটি রাশিয়ার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায়, অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্টের মাধ্যমে নির্মিত হচ্ছে।
প্রকল্প পরিচালনায় ভারতের বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে সহায়তা প্রদান করলেও গত বছর থেকে তারা আর আসছে না। ফলে যন্ত্রপাতি তদারকি এবং প্রকল্প তদারকিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ দাবি করে, রূপপুরে বেতন অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় আড়াই গুণ বেশি, এবং কর্মীদের অসন্তোষের যৌক্তিকতা নেই।
কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগে কর্মচারীরা বিভিন্ন দাবি নিয়ে গত বছর আন্দোলন চালায়। এতে অনেককে বরখাস্ত ও ছাঁটাই করা হয়েছে। বরখাস্ত হওয়া কর্মচারীরা রিটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কর্তৃপক্ষ বলছে, যারা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যক্রম ব্যাহত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও নেওয়া হবে।
চুক্তি অনুযায়ী রূপপুর প্রকল্পের মেয়াদ ডিসেম্বর ২০২৭ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, তবে খরচ বাড়ানোর সুযোগ নেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জন্য। প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের ডিসেম্বর, যা এখন আরও পিছিয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর হয়েছে। দ্বিতীয় ইউনিট থেকে উৎপাদনের সম্ভাবনা ২০২৭ সাল পর্যন্ত পেছানো হয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, গত সেপ্টেম্বর চুল্লিপাত্রে ‘ডামি’ জ্বালানি প্রবেশ করানো হয়েছে। সঞ্চালন লাইন তৈরির পর দুই মাসের মধ্যে পারমাণবিক জ্বালানি প্রবেশ করানো হবে। এরপর পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। তবে উৎপাদন শুরু হওয়ার তারিখ এখনও নিশ্চিত নয়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোকাব্বির হোসেন বলেন, যারা উপদ্রব করেছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং নেওয়া হবে। এটি একটি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োজিত আছে এবং কাজ স্বাভাবিকভাবেই চলছে।
নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারমাণবিক জ্বালানি প্রবেশের পর অন্তত ছয় মাস পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলবে। এতে আন্তর্জাতিক অনুমতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সময় লাগবে। তাই আগামী বছরের আগেই বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হওয়া সম্ভব না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম বলেন, বারবার দেরির পরও রূপপুর প্রকল্পের স্থায়ী চালু হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো নিশ্চয়তা নেই। নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। বর্তমান সরকার এই প্রকল্পে পর্যাপ্ত অগ্রাধিকার দিচ্ছে না বলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে প্রকল্পের খরচও বাড়তে পারে এবং এর বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।